যোগাযোগে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হয়। নিচে কয়েকটি ঘটনা দেওয়া হলো। ঘটনাগুলোর সঙ্গে দেওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। উত্তরগুলো নিয়ে সহপাঠীর সাথে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো। প্রথমটি করে দেখানো হলো।
টিফিনের সময়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামিয়া ও নয়ন কথা বলছে।
সামিয়া: আগামী শুক্রবার আমার ছোটো বোনের জন্মদিন। তুমি ঐদিন বিকেলে আমাদের বাসায় এসো। রীতা, মিতু ও শাহেদকে আসতে বলেছি।
নয়ন: ধন্যবাদ সামিয়া। আমি বাসায় মার সাথে কথা বলে তোমাকে জানাব।
সামিয়া: ঠিক আছে। তুমি এলে আমার অনেক ভালো লাগবে। আমরা সবাই মিলে অনেক মজা করতে পারব। আমার মাকেও আমি তোমার কথা বলেছি।
সামিয়ার যোগাযোগের উদ্দেশ্য কী? | জন্মদিনের দাওয়াত দেওয়া। |
এই যোগাযোগে কোন চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে? | বন্ধুরা মিলে আনন্দ করা। |
আর কীভাবে সামিয়া উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে পারত? |
|
৫ই জুন। বিশ্ব পরিবেশ দিবস। স্কুলের সামনে বড়ো একটি ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে শিক্ষকরাও আছেন। ব্যানারে লেখা 'গাছ লাগাও পরিবেশ বাঁচাও'। কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতে কয়েকটি প্ল্যাকার্ড দেখা যাচ্ছে। সেখানে এই বিশেষ দিনটি উপলক্ষ করে কিছু কথা লেখা আছে।
শিক্ষার্থীরা কোন উদ্দেশ্যে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়েছে?
| |
এই যোগাযোগে কোন চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে?
| |
আর কীভাবে তারা এই উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে পারত?
|
শিমুর ছোটো ভাইয়ের বয়স বারো বছর। সকাল থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যার সময়ে থানায় শিমুর বাবা ও চাচা কথা বলছেন পুলিশ অফিসারের সাথে।
পুলিশ: সকাল কয়টা থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না বললেন?
বাবা : সকাল নয়টা থেকে। পুলিশ সে কেন ঘর থেকে বের হয়েছিল বলতে পারেন?
বাবা : সম্ভবত মোড়ের দোকানে চকলেট কিনতে গিয়েছিল।
পুলিশ : তার কোনো ছবি আছে আপনাদের কাছে? [বাবা ছবি এগিয়ে দিলেন পুলিশ অফিসারের দিকে।]
পুলিশ: আপনারা কি ওর বন্ধুদের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছেন?
চাচা : আমরা ওর কয়েকজন বন্ধুর বাড়ি ফোন করেছিলাম। কারো বাড়িতেই সে যায়নি।
পুলিশ : আপনারা একটি লিখিত অভিযোগ করে যান। আমরা দেখছি।
শিমুর বাবা কোন উদ্দেশ্যে থানায় যোগাযোগ করেছেন?
| |
এখানে শিমুর বাবার কোন চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে?
| |
অন্য কীভাবে শিমুর বাবা এ উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে পারতেন?
|
আমরা বিভিন্ন উপায়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ করি। এসব যোগাযোগের পিছনে এক বা একাধিক উদ্দেশ্য থাকে। কারো খবর নেওয়া, কাউকে দাওয়াত দেওয়া, কোনো কিছু চাওয়া, কোনো উত্তর খোঁজা কিংবা আরো নানা প্রয়োজনে যোগাযোগের দরকার হয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কের ধরন অনুযায়ী যোগাযোগের উদ্দেশ্য নানা রকম হয়।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষিক ও অভাষিক দুটি ধরন রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা লিখে, বলে, ইশারা ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করি। যোগাযোগের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হয়। কাউকে জন্মদিনের দাওয়াত যেভাবে দেওয়া যায়, শোকসন্তপ্ত পরিবারের কারো সাথে সেভাবে কথা বলা যায় না। কথা বলার সময়ে প্রসঙ্গকে বিবেচনায় নিতে হয়। মর্যাদা অনুযায়ী সর্বনাম ও ক্রিয়াশব্দের ব্যবহারের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। যোগাযোগের সময়ে উদ্দেশ্য অনুযায়ী চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ যথাযথ হলো কি না, সেটি খেয়াল করতে হয়। ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের উদ্দেশ্য এক রকম হয় না। উদ্দেশ্য অনুযায়ী যোগাযোগের যথাযথ উপায় বেছে নিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই প্রয়োজনে একাধিক উপায়ে যোগাযোগ করার দরকার হয়।
মৌখিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অঙ্গভঙ্গি, গলার স্বর, তাকানোর ধরন ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ। মৌখিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেভাবে পরিস্থিতি, চিন্তা-অনুভূতি ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করা যেতে পারে, তার একটি নমুনা নিচে দেওয়া হলো:
যোগাযোগের উদ্দেশ্য | যেভাবে পরিস্থিতি তুলে ধরা যেতে পারে | যেভাবে চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশ করা যেতে পারে | যেভাবে উদ্দেশ্য প্রকাশ করা যেতে পারে |
বন্ধুর জন্মদিনে যোগ দেওয়ার জন্য অভিভাবকের কাছে অনুমতি চাওয়া। | মা, সামনের শুক্রবার আমার এক বন্ধুর জন্মদিন। সেদিন বিকালে আমাদের ক্লাসের কয়েকজনকে দাওয়াত দিয়েছে। | সেদিন অনেক মজা হবে। সেখানে গেলে সবাই মিলে অনেক আনন্দ করতে পারব। | বিকালের অনুষ্ঠান শেষ করে আমি সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরব। এই অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে আমি তোমার অনুমতি চাই। |
লিখিত যোগাযোগের সময়ে অঙ্গভঙ্গি, গলার স্বর, তাকানোর ধরন ইত্যাদির সুযোগ নেই। তাই লিখিত যোগাযোগের ক্ষেত্রে শব্দ ও বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে সেই অভাব পূরণ করতে হয়।
লিখিত যোগাযোগ নানা ধরনের হয়ে থাকে; যেমন-ব্যক্তিগত যোগাযোগ, প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ, ব্যবসায়িক যোগাযোগ ইত্যাদি। এসব যোগাযোগের কাঠামোও আলাদা। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের নমুনা হিসেবে একটি আবেদনপত্রের কাঠামো দেখানো হলো। এই আবেদনপত্রে ক্লাসরুমে পাঠাগার তৈরির জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা আবেদন করছে।
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
প্রধান শিক্ষক ফুলঝুরি উচ্চ বিদ্যালয় বরগুনা সদর উপজেলা বরগুনা। বিষয়: ক্লাসরুম পাঠাগার তৈরির জন্য অনুমতি ও অনুদানের আবেদন। মহোদয় আমরা ফুলঝুরি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আমাদের ক্লাসরুমের ভিতরে আমরা একটি পাঠাগার তৈরি করতে চাই। ক্লাসরুমের ভিতরে একটি পাঠাগার থাকলে বিরতির সময় আমরা বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে পারব যা আমাদের অনেকেরই পছন্দের কাজ। পাঠাগার স্থাপনের জন্য আমাদের একটি বইয়ের সেলফের প্রয়োজন, যা শ্রেণিকক্ষের এক কোনায় রাখা হবে। এছাড়া এই সেলফে রাখার জন্য কিছু বই কেনারও প্রয়োজন। শ্রেণিশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আমরা এই পাঠাগার পরিচালনা করতে চাই। এজন্য আপনার সদয় অনুমতি এবং আর্থিক অনুদান কামনা করি।
বিনীত অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীবৃন্দ, ফুলঝুরি উচ্চ বিদ্যালয়।
|
নিচের গল্পটি রাবেয়া খাতুনের (১৯৩৫-২০২১) লেখা। তিনি মূলত কথাসাহিত্যিক। তাঁর 'মেঘের পরে মেঘ', 'মধুমতী', 'কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি' এসব উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ছোটোদের জন্য তিনি অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন।
আজকাল দাদি সহস্রদল চম্পকদলের গল্প বলতে গিয়ে প্রায়ই বলে বসেন, 'জাগে চম্পকদল, জাগে সহস্রদল, আর জাগে জয় বাংলা রেডিও।'
চন্দন চাপা গলায় বলে ওঠে, 'ও দাদি, তোমার হলো কী?'
আন্না বড়ো একটা হাই তুলে বলল, 'কী আবার হবে, আমার মতো ঘুম ধরেছে।'
মান্না সঙ্গে সঙ্গে চেঁচায়, 'বলিস কিরে, মোটে রাত আটটা।'
আসলেও তাই। বাইরে জরুরি অবস্থা অন্ধকার। গোটা বাড়িতে আলো বলতে একটিমাত্র সলতে-কমানো নিভু- নিভু হারিকেন। রেডিয়াম দেওয়া টেবিলঘড়িতে জ্বলজ্বল করছে শুধু আট সংখ্যাটা।
এমন সন্ধ্যে রাতে ক মাস আগেও গমগম করত রাস্তাঘাট। ভাইয়া প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে পড়ে বাসায় ফিরত। ছোটো চাচা ফিরত র্যাকেট ঘোরাতে ঘোরাতে ব্যাডমিন্টন কোর্ট থেকে। রাস্তার ওপারে দোকানগুলোর কোনোটায় জ্বলত রঙিন বাল্ব। কোনোটা থেকে বাজত চড়া স্বরে রেডিওর গান। চায়ের স্টলে পেয়ালার গরম ধোঁয়ার সঙ্গে আরো গরম কথাবার্তা। শেখ মুজিব, মুক্তিযোদ্ধা, ইয়াহিয়া খান,... নানা রকমের নাম, আলোচনা। চন্দন ঠিক বুঝতে পারত না। কিন্তু দিনভর ওইসব কথাই শুনত ট্রানজিস্টারে, খেলার মাঠে, যেখানে-সেখানে। একটা যুদ্ধ আসার কথা সবার মুখে মুখে। যুদ্ধ শব্দটা অচেনা কিছু নয়। রূপকথার বই থেকে ইতিহাসের বই- সব জায়গাতেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাধে। কখনো সীমানা নিয়ে, কখনো রাজপুত্র-রাজকন্যা নিয়ে। শেষটায় যে পক্ষ সৎ সেই জিতে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধটা যেন কেমন। রাজায়-প্রজায় যুদ্ধটাও আবার মুখোমুখি নয়। মাঠে-ময়দানে নয়। রাজার সৈন্যরা যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে।
লড়াই শুরু হতে না হতেই গোবেচারা ছোটো চাচাকে হাত বেঁধে, জিপে করে কোথায় যেন নিয়ে গেল। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। আজও ফেরার নাম নেই। কেউ বলে, তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। কেউ বলে বন্দি করে রাখা হয়েছে কুর্মিটোলার শিবিরে। শুধু ছোটো চাচা নয়, এই কয় মাসে নান্টুর চাচা, দিলুর বড়ো ভাই, ননির বাবা-আরো কতজনকে যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেউ ফেরেনি। কারো কোনো খবরও নেই। এখন মাগরেবের পর সারা পাড়া নিঝুম হয়ে যায়। অন্ধকার হয়ে যায়। কোথাও কোনো আলো নেই। শব্দ নেই। অথচ এখানে থাকে কয়েক হাজার মানুষ। এখন যেন পুরো মহল্লা রূপকথার সেই রাক্ষসপুরীর মতো হয়ে গেছে। রাজার রাজ্যে একটিও জ্যান্ত লোক নেই। সব গেছে রাক্ষসের পেটে।
দাদি অবশ্য বলেন, 'রাক্ষসের গিলে-খাওয়া এই মানুষগুলো একদিন দেখিস ঠিক ফিরে আসবে।'
আন্না খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, 'সত্যি? কেমন করে?'
'দেখবি আমাদের পাড়ার এই রাস্তাঘাট খান সেনাদের বদলে ভরে যাবে মুক্তিসেনায়। ওরা এখন সংখ্যায় কম বলে বনে-জঙ্গলে থেকে যুদ্ধ করছে। এ যুদ্ধকে বলে গেরিলা যুদ্ধ।'
মান্না মাথার ওপর হাত তুলে বলে, 'আমরাও তাহলে যুদ্ধ করছি।'
চন্দন চাপা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, 'এই জন্যই তো তোকে দলে নিতে চাইনি।'
মান্না দু কানের লতি ছুঁয়ে বলল, 'আর ভুল হবে না ভাইয়া।'
চন্দন খুশি হয়ে ওঠে। দু বছরের বড়ো হলেও মান্না ওকে নাম ধরেই ডাকে। শুধু এইসব বেগতিক সময়ে ডাকে ভাইয়া। সেও তখন গম্ভীর মুখে আস্তে আস্তে বলে, 'কাল আমাদের অপারেশন। মনে আছে তো?'
মান্না জবাব দেয়, 'আছে আছে। খুব আছে। কাল তো জুম্মাবার। সবাই বাবার সঙ্গে পাজামা, পাঞ্জাবি, টুপি পরে মসজিদে যাব। তারপর ...।'
দাদি আবার কথা বলছেন। ওরা ভেবেছিল দাদির চোখে ঘুম নেমেছে। এখন বুঝল আসলে জমেছিল পানি। আঁচলে চোখ ঘষে আবার শুরু করলেন, 'রাজার রাজ্যের শেষ সীমানায় শেওলাধরা পোড়োবাড়ি। দুই ভাই সহস্রদল, চম্পকদলকে পাঠানো হয়েছে বক-রাক্ষসের খাবার হিসেবে। রাক্ষস বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, ভেতরে কে ঘুমায়? দুই ভাই পরামর্শ করে রাত জাগছিল। ঘুমিয়ে গেলেই বক-রাক্ষস দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ওদের খেয়ে ফেলবে। তখন ছিল চম্পকদলের পালা। সে আবার একটু ঘুমিয়েও পড়েছিল। রাক্ষসের বিকট গলা শুনে জেগে উঠে জবাব দিল, কেউ ঘুমায় না। জাগে সহস্রদল। জাগে চম্পকদল। আর জাগে...।'
দাদিকে থেমে যেতে হয়। নিভু নিভু হারিকেনের কাছে খুব কম আওয়াজে বাজছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান-মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি...।
সবাই যখন গান শোনায় চুপচাপ, মান্নার হাত ধরে চন্দন বারান্দার কোণে এসে দাঁড়াল। পথে শুধু থমথমে বিদঘুটে অন্ধকার। টহলদার শত্রুসেনাদের বুটের বিশ্রী শব্দ। সেই সঙ্গে কুকুরদের আর্তনাদ। আজকাল সারারাত ওরা ডাকে। দাদি বলেছেন, বোবা জানোয়ারেরা নাকি বিপদ-আপদ মানুষের আগে বুঝতে পারে। পঁচিশে মার্চের মাঝরাত থেকে সেই যে কুকুর ডাকা শুরু হয়েছে, কে জানে কবে থামবে। শফি ভাই অবশ্য বলেছেন, বেশি দিন আর নেই। অত্যাচারী রাজা ইয়াহিয়া আর তার মন্ত্রী টিক্কা খানের রাজত্ব গেল বলে। খুব চাপা স্বরে চন্দন বলল, বুঝলি মান্না, কাল থেকে শুরু হয়ে যাবে খাস ঢাকা শহরের ভেতর নানা দিকের অপারেশন। এই পাড়ায় যখন প্রথম এলাম তখন কান্না পেয়েছিল। কোথায় গ্রিন রোড, কোথায় বাসাবো। এখানে ছিলাম বলে কদমতলী অপারেশনের সুযোগ পেয়ে গেলাম। তোকে কী করতে হবে, মনে আছে তো?'
'আছে। বাবার সঙ্গে আমি ঠিকই মসজিদে উঠব, তুই কেটে যাবি পিছন থেকে।'
'আর আমি সহিসালামতে ফিরে আসামাত্র কিংবা যদি মারাও পড়ি, পাড়ায় ছড়িয়ে দিবি হাজার হাজার খানসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে মারা গেছে।'
'ঠিক আছে, চল ঘুমাতে যাই।'
'তুই যা। আমি আরো কিছুক্ষণ জেগে টহলদার শয়তানের বাচ্চাগুলোর বুটের শব্দের জবাব দিয়ে যাই-জাগে চন্দন, জাগে মান্না।'
আর জাগে বাসাবোর পোলাপানেরা।
মার ডাকে কখন ঘরে গিয়ে শুয়েছিল মনে নেই চন্দনের। ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে বুক কাঁপল। আজকাল পাখি ডাকা মানে সকাল হওয়া নয়। খানসেনারা সারা রাত ভরে যখন-তখন মুড়ি-মটরের মতো রাইফেলের গুলি ছোড়ে। ভয় পেয়ে ঘুমন্ত পাখিরা বাসা ছেড়ে অস্থির ডানায় চক্কর দিতে থাকে শূন্যে। ওদের ভয়ার্ত কান্নায় পাড়ার মানুষের ঘুম ভাঙে। কিন্তু কিছু করতে পারে না। পাশের বাড়ির খালু, দুশো বিশ নম্বর বাড়ির সানু, মানু, দুলি আপাকে যখন অকারণে বন্দুকের নলের মুখে তুলে নিয়ে গেল, তখন কেউ টু শব্দও করতে পারেনি জবাব দিতে পারেনি তাদের করুণ কান্নার। তাই পাখির ডাক এখন ভোর হওয়ার আনন্দের নয়, নিশি রাতের আতঙ্কের।
দু চোখ ডলে এখন অবশ্য চন্দন বুঝতে পারল, সত্যি সকাল হয়েছে। চারদিকে ঠান্ডা সূর্যের আলো। কিন্তু ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ যেতেই রক্ত গরম হয়ে গেল ২৫শে ভাদ্র, ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
চা-নাশতা সেরে, ঘড়ির দিকে চেয়ে অস্থির সময় কাটতে লাগল, কখন মসজিদের মিনার থেকে শোনা যাবে আজানের আওয়াজ। ত্রিবেণীর মুক্তিসেনা-শিবির থেকে ওই সময়ে দুটো ছইওয়ালা একটি জিপে করে বেরুবেন অপারেশনের ভাইয়েরা, তার কাজ কদমতলীর ফাঁড়ির দিকে বিলের বিশেষ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সব কিছু ঠিক আছে তার সংকেত দেখানো।
দুপুরে বিলের সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে খবর পেল অপারেশনের কথা শুধু চন্দনরাই নয়, খানসেনারাও দেশি মীরজাফরদের কাছ থেকে জেনে ফেলেছে। তবে কিছু দেরিতে। ওরা দলেবলে পৌঁছানোর আগে যা ঘটার ঘটে যাবে।
পাকুড়গাছের মগডালের পাতার আড়াল থেকে সবুজ নিশান তিন বার দেখাতেই, যেন পানির অতল থেকে হঠাৎ। উঠে এলো তিন তিনটি নৌকা। খাল আর বিল পেরিয়ে তারা এগোতে লাগল ফাঁড়ির দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফটাফট বন্দুকের আর রাইফেলের শব্দ। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঢেকে গেল পুলিশ ফাঁড়ির চারদিক। ধোঁয়ার ভেতর থেকে আসতে লাগল নানা রকম কাতর শব্দ।
পাকুড়গাছ থেকে নেমে চন্দন দৌড় লাগাল। কদমতলী, মাদারটেক, মুগদাপাড়া, সবুজবাগ রাস্তায় ছুটতে ছুটতে চন্দন চেঁচিয়ে বেড়াতে লাগল, 'কে কোথায় আছেন, মুক্তিরা ফাঁড়ি আক্রমণ করেছে...।'
রাস্তার ধারে ধারে ওর বয়সী যারা ছিল, সেইসব ছেলেও দলে যোগ দিয়ে বলতে লাগল, 'ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্তি ভাইয়েরা... হাজার দু হাজার...।'
ওদিকে নামাজ শেষে মুসল্লিরা শুনলেন চারদিক কাঁপছে রাইফেল, মেশিনগান আর মর্টারের আওয়াজে। তার ভেতর বালকের দল দুজন চারজন করে ভাগে ভাগে, ছুটে ছুটে বিলি করছে নতুন খবর হাজারে হাজারে মুক্তি এসেছে... রাতে নয়, দিনে-দুপুরে। মরেছে ফাঁড়ির পুলিশ, রাজাকার, আহত হয়েছে মেলা, আর লুট হয়েছে ফাঁড়ির নানা রকমের অস্ত্র।
ছেলেদের দুঃসাহসে ফাঁড়ির লোক প্রথমে কেঁপে উঠেছিল ত্রাসে। এই বুঝি অবুঝ দামাল ছেলেগুলোকে জিপে করে চালান দেয় কুর্মিটোলার বন্দিশিবিরে। কিন্তু দেখা গেল জালিম রাজার সৈন্যরা ব্যস্ত নিজেদের রক্ষার কাজে। ট্রাক সাদা পর্দায় ঢেকে দ্রুত সরানো হচ্ছে কদমতলী থেকে আহত-নিহত খানসেনাদের আর বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের।
ওদিকে যাদের জন্য এতসব, সেই মুক্তিযোদ্ধারা বিলের কোথায় যে মিলিয়ে গেছে, খানসেনারা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হদিস পেল না।
বারান্দার কোণে বসে গেন্ডারি খেতে খেতে চন্দন বলল, 'পাবে কী করে? ভাইয়েরা জব্বর চালাক। কেউ চাষিদের সঙ্গে মিশে গেছেন, কেউ মাঝিদের, কেউ কেউ জেলেদের। খানরা কি তাদের আলাদা করে চেনে!'
মান্না বলল, 'সাবধান, ভাইয়া বলেছেন ওসব এখন নয়। এখন শুধু গেন্ডারি খেতে খেতে দেখব রাতে খানসেনারা আর কত গুলি ফোটায়।"
মান্না বলল, 'যাই বলিস ভাইয়া, সত্যি সত্যি মুক্তিযুদ্ধের কাজে এসেছি। তুই অপারেশনে অংশ নিয়েছিস! ভেবে যেমন অবাক হচ্ছি, তেমনি ভালোও লাগছে খুব। আর এই খবরটা যখন জয় বাংলা থেকে শুনব, তখন আরো কত ভালো লাগবে কে জানে!
শব্দের অর্থ
অপারেশন: বিশেষ অভিযান।
বেগতিক: উপায়হীন।
আতঙ্ক: ভয়।
রাক্ষসপুরী: রাক্ষসদের বাসস্থান।
গেরিলা যুদ্ধ: নিজেকে লুকিয়ে রেখে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করা হয় এমন যুদ্ধ।
রেডিয়াম: একটি তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ।
চম্পকদল: রূপকথার একটি চরিত্রের নাম।
সলতে: প্রদীপ জ্বালাতে ব্যবহৃত হয় এমন টুকরো কাপড় বা মোটা সুতা।
টহলদার: পাহারাদার।
সহস্রদল: রূপকথার একটি চরিত্রের নাম।
দুঃসাহস: অতিরিক্ত সাহস।
সহিসালামতে: নিরাপদে।
নিঝুম: নীরব।
আরও দেখুন...